ডিজিটাল মার্কেটিং হল একটি আধুনিক মার্কেটিং কৌশল যা ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা প্রচার ও গ্রাহকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে।
বর্তমান সময়ে যেকোনো ব্যবসার জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কারণ গ্রাহকরা প্রতিদিনই বেশি সময় ইন্টারনেট ও ডিজিটাল মিডিয়াতে ব্যয় করছেন।
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ব্র্যান্ডকে দ্রুত প্রসারিত করা এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা সহজ হয়।
ডিজিটাল মার্কেটিং কি?
ডিজিটাল মার্কেটিং হল এমন একটি মার্কেটিং পদ্ধতি যা ডিজিটাল চ্যানেল এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা প্রচার করে। এটি অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মাধ্যমেই কার্যকরী মার্কেটিং কৌশল ।
ডিজিটাল মার্কেটিং এর প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান ডিজিটাল এই যুগে ডিজিটাল মার্কেটিং এর গুরুত্ব অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। ডিজিটাল মার্কেটিং এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :
১. গ্রাহক আচরণের পরিবর্তন
আজকের গ্রাহকরা ক্রয়-বিক্রয়ের আগে প্রায়ই অনলাইনে পণ্য ও সেবা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। তাই ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছানো অপরিহার্য। ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক ব্যবহারের ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত না থাকলে একটি ব্র্যান্ড গ্রাহকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারে।
২. বিশ্বব্যাপী গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয় বা দেশীয় সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। তাই এটি আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করতে সহায়তা করে।
৩. প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে এবং প্রতিযোগীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে ডিজিটাল মার্কেটিং অপরিহার্য। অনেক ব্যবসা এখন অনলাইনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। কেবলমাত্র অফলাইন ভিত্তিক মার্কেটিংয়ের উপর নির্ভর করলে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. কম খরচে মার্কেটিং
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে প্রচারণার খরচ কমানো সম্ভব। প্রথাগত মার্কেটিং, যেমন টিভি, রেডিও বা প্রিন্ট বিজ্ঞাপনের তুলনায় ডিজিটাল বিজ্ঞাপন অনেক বেশি সাশ্রয়ী। বিশেষ করে ছোট ব্যবসার জন্য এটি একটি কার্যকর মাধ্যম।
৫. নির্ভুল লক্ষ্যভিত্তিক প্রচারণা (Targeted Marketing)
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের অন্যতম বড় সুবিধা হল নির্দিষ্ট গ্রাহকগোষ্ঠীর দিকে টার্গেট করা। উদাহরণস্বরূপ ফেসবুক বা গুগল অ্যাডসের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বয়স, লোকেশন বা আগ্রহের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যায়।
আরও পড়ুন : একজন নতুন মার্কেটার হিসেবে কিভাবে ডিজিটাল মার্কেটিং শুরু করবেন?
৬. রিয়েল-টাইম ফলাফল এবং বিশ্লেষণ সুবিধা
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে ফলাফল পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করা যায়। কোন বিজ্ঞাপন কীভাবে পারফর্ম করছে, কতজন দেখছে, কতজন ক্লিক করছে বা কনভার্ট হচ্ছে, এসব তথ্য দ্রুত জানা যায়।
৭. ব্যবসার ব্র্যান্ড সচেতনতা বৃদ্ধি: ডিজিটাল
মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে একটি ব্যবসার ব্র্যান্ড পরিচিতি দ্রুত বৃদ্ধি করা সম্ভব। সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ভিডিও, এবং ইমেইল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ব্র্যান্ড সম্পর্কে গ্রাহকের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়া যায়।
ডিজিটাল মার্কেটিং এর সুবিধা
ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরণের সুবিধা পেতে পারে। যেমন;
১. বৃহৎ শ্রোতাদের কাছে সহজে পৌঁছানো
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গ্রাহকদের কাছে সহজেই পৌঁছানো যায়। সঠিক কৌশল ব্যবহার করে ব্যবসার বার্তা লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে।
২. উচ্চ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (ROI)
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে অল্প বিনিয়োগে বেশি লাভ করা সম্ভব। পেইড অ্যাড ক্যাম্পেইন, ইমেইল মার্কেটিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত এবং সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে ROI বাড়ানো সম্ভব।
৩. নির্দিষ্ট টার্গেটিং এবং ব্যক্তিকেন্দ্রীক ক্যাম্পেইন
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাস্টমার সেগমেন্টকে টার্গেট করা যায়। বিশেষ করে কাস্টমাইজড বিজ্ঞাপন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রীক ইমেইল ক্যাম্পেইন গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করতে সহায়ক হয়।
৪. কন্টেন্ট মার্কেটিং এবং ব্র্যান্ডের কণ্ঠস্বর তৈরি
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে কন্টেন্ট তৈরি করে গ্রাহকদের সমস্যার সমাধান প্রদান করা যায়। ব্লগ, ই-বুক, ভিডিও ইত্যাদির মাধ্যমে আপনার ব্র্যান্ডের কণ্ঠস্বর তৈরি করা সম্ভব, যা গ্রাহকদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
৫. ডেটা ড্রাইভেন মার্কেটিং
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলোকে ডেটা-ভিত্তিক করা যায়। গ্রাহকের আচরণ বিশ্লেষণ করে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হয়, যা বিজ্ঞাপন বা প্রচারণার ফলাফলকে আরও উন্নত করে।
৬. গ্রাহক এনগেজমেন্ট বৃদ্ধি
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো, যেমন ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদি গ্রাহকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করে। এর ফলে গ্রাহকরা ব্র্যান্ডের সাথে আরও বেশি যুক্ত থাকে এবং এনগেজমেন্ট বাড়ে।
৭. মোবাইল ব্যবহারকারীদের টার্গেট করা
আজকাল অনেক গ্রাহক মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্রাউজ করে। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে মোবাইল ব্যবহারকারীদেরও লক্ষ্যবস্তু করা যায় এবং মোবাইল-ফ্রেন্ডলি কনটেন্ট তৈরি করা যায়।
৮. ফ্লেক্সিবিলিটি এবং স্কেলেবিলিটি
ডিজিটাল মার্কেটিং অত্যন্ত ফ্লেক্সিবল এবং স্কেলেবল। আপনি চাইলে বিজ্ঞাপনের বাজেট, টার্গেট অডিয়েন্স, অথবা কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি দ্রুত পরিবর্তন করতে পারেন এবং এটি আপনার ব্যবসার আকার অনুযায়ী সহজেই মানানসই হয়ে যায়।
ডিজিটাল মার্কেটিং এর উপাদান
ডিজিটাল মার্কেটিং-এর কিছু মূল উপাদান নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (SEO)
এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সার্চ ইঞ্জিনে একটি ওয়েবসাইটের দৃশ্যমানতা বাড়ানোর হয়। SEO এর জন্য বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় যেমন কিওয়ার্ড রিসার্চ, অন-পেজ অপটিমাইজেশন, অফ পেইজ এসইও, লিংক বিল্ডিং অন্তর্ভুক্ত, লোকাল এসইও ইত্যাদি।
২. কন্টেন্ট মার্কেটিং
কন্টেন্ট মার্কেটিং হচ্ছে ব্র্যান্ডের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য তথ্যবহুল এবং মূল্যবান কন্টেন্ট তৈরি ও বিতরণ করার প্রক্রিয়া। ব্লগ, ভিডিও, ইনফোগ্রাফিক এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ইত্যাদি কন্টেন্ট মার্কেটিং-এর অংশ।
আরও পড়ুন : কন্টেন্ট মার্কেটিং কি? কিভাবে কন্টেন্ট মার্কেটিং করা হয়?
৩. সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
এটি সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম (যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার) ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা প্রচার করার একটি পদ্ধতি। সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং-এর মাধ্যমে ব্র্যান্ড সচেতনতা বাড়ানো এবং গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়।
৪. ইমেইল মার্কেটিং
এটি গ্রাহকদের কাছে সরাসরি ইমেইল পাঠিয়ে প্রচার এবং সম্পর্ক তৈরি করার একটি মাধ্যম। ইমেইল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে নতুন পণ্য, অফার এবং আপডেটগুলো শেয়ার করা হয়।
৫. পে-পার-ক্লিক (PPC) বিজ্ঞাপন
এটি একটি বিজ্ঞাপন মডেল যেখানে বিজ্ঞাপনদাতারা ক্লিক প্রতি অর্থ প্রদান করে। Google Ads এবং ফেসবুক অ্যাডস এই ধরনের বিজ্ঞাপনের উদাহরণ।
৬. অ্যানালিটিক্স
ডিজিটাল মার্কেটিং কার্যক্রমের কার্যকারিতা পরিমাপ করতে এবং উন্নতি সাধন করতে অ্যানালিটিক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গুগল অ্যানালিটিক্স এবং অন্যান্য টুল ব্যবহার করে ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়।
৭. ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং
ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং হল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা প্রচার করা। সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের ফলোয়ারদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা ব্র্যান্ডের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী একটি মাধ্যম হতে পারে।
৮. অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং
এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আপনার পণ্য বা সেবা বিক্রি করা হয় এবং সেই তৃতীয় পক্ষ কমিশন পায়। বর্তমানে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।
৯. ভিজ্যুয়াল এবং ভিডিও মার্কেটিং
ভিডিও এবং চিত্রের মাধ্যমে প্রমোশন করার পদ্ধতিকে ভিজ্যুয়াল এবং ভিডিও মার্কেটিং বলে । যেমন YouTube ভিডিও, ইনস্টাগ্রাম রিলস বা টিকটক ভিডিও মার্কেটিং। ভিডিও কনটেন্ট সহজে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং দ্রুত শেয়ার হয়ে থাকে।
১০. মোবাইল মার্কেটিং
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ডিজিটাল মার্কেটিং করা হয়। এসএমএস, মোবাইল অ্যাপ, মোবাইল অ্যাড এবং মোবাইল-অপ্টিমাইজড ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পণ্য বা সেবা পৌঁছানো হয়।
১১. রিটার্গেটিং
এটি এমন একটি কৌশল যেখানে পূর্বে আপনার ওয়েবসাইটে ভিজিট করা ব্যবহারকারীদের পুনরায় টার্গেট করা হয়। এর মাধ্যমে তাদের আবারও পণ্য বা সেবা কেনার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
১২. চ্যাটবট এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) মার্কেটিং
এখন অনেক প্রতিষ্ঠান AI এবং চ্যাটবট ব্যবহার করে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করে এবং মার্কেটিং কার্যক্রম চালায়। এটি দ্রুত গ্রাহক সেবা প্রদান ও কার্যকর যোগাযোগে সহায়তা করে।
১৩. অনলাইন পিআর (Public Relations)
অনলাইন পিআর-এর মাধ্যমে ইন্টারনেটে আপনার ব্র্যান্ডের ইতিবাচক উপস্থিতি তৈরি করা হয়। ব্লগ, নিউজ সাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্র্যান্ডের ভালো সম্পর্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো হয়।
১৪. ওয়েবিনার এবং লাইভ ভিডিও মার্কেটিং
ওয়েবিনার এবং লাইভ ভিডিও ইভেন্ট এর মাধ্যমে সরাসরি গ্রাহকদের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এটি ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে এবং কাস্টমার এনগেজমেন্ট বাড়াতে সাহায্য করে।
১৫. কনভার্সেশনাল মার্কেটিং
এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো রিয়েল-টাইমে গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। লাইভ চ্যাট, চ্যাটবট এবং মেসেজিং প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে কাস্টমারদের প্রশ্নের দ্রুত উত্তর দেওয়া হয়।১
১৬. ভয়েস সার্চ অপ্টিমাইজেশন
বর্তমানে অনেক ব্যবহারকারী ভয়েস সার্চ (যেমনঃ Siri, Google Assistant) ব্যবহার করে তথ্য খোঁজেন। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ভয়েস সার্চ অপ্টিমাইজেশন এর গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর ফলে ব্র্যান্ডগুলো ভয়েস সার্চের ফলাফলে প্রথম দিকে স্থান পায়।
পরিশেষ
এই উপাদানগুলো ডিজিটাল মার্কেটিং প্রচারণায় নতুন মাত্রা যোগ করে, যার মাধ্যমে ব্র্যান্ডগুলো তাদের টার্গেট করা গ্রাহকদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে পারে। ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্র্যান্ডগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করছে।