ড্রপশিপিং কি?
ড্রপশিপিং বিজনেস হলো একটি ই-কমার্স বিজনেস মডেল যেখানে বিক্রেতা কোনো পণ্য স্টকে রাখে না। এর পরিবর্তে, বিক্রেতা যখন একটি অর্ডার পায়, তখন সরাসরি তৃতীয় পক্ষ (সাপ্লায়ার বা প্রস্তুতকারক) সেই পণ্যটি ক্রেতার কাছে পাঠিয়ে দেয়। বিক্রেতা মূলত একটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।
ড্রপশিপিং বিজনেস মডেল কিভাবে কাজ করে?
এই ব্যবসার মডেল মূলত চারটি ধাপে কাজ করে :
১. অনলাইন স্টোর তৈরি করা: ড্রপশিপিং বিজনেস মডেলে প্রথমে থাকবে অনলাইন স্টোর। প্রথমে আপনাকে একটি অনলাইন স্টোর তৈরি করতে হবে যেখানে আপনি বিভিন্ন পণ্য গ্রাহকদের সামনে প্রদর্শন করবেন ।
এই ড্রপশিপিং ব্যবসার একটি বিশেষ দিক হলো এখানে আপনার নিজের পণ্য থাকতে হবে না সাপ্লায়ারের পণ্য স্টোরে প্রদর্শন করবেন ।
২. ক্রেতা অর্ডার করে: একজন ক্রেতা আপনার ওয়েবসাইটে এসে একটি পণ্য অর্ডার করে। ক্রেতা পণ্যটির জন্য আপনাকে অর্থ প্রদান করে।
৩. সরবরাহকারীর কাছ থেকে পণ্য ক্রয়: ক্রেতার নিকট থেকে অর্ডার পাওয়ার পর তা আপনাকে সরাসরি আপনার সরবরাহকারী বা প্রস্তুতকারীর কাছ থেকে পণ্যটি ক্রয় করতে হবে এবং তাদেরকে ক্রেতার ঠিকানা দিতে হবে।
৪. সরবরাহকারী কর্তৃক পণ্য পাঠানো: সরবরাহকারী পণ্যটি প্যাকেজিং করে সরাসরি ক্রেতার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এতে আপনার কাজ হলো শুধুমাত্র অর্ডার গ্রহণ করা এবং সরবরাহকারীকে জানানো।
আরও পড়ুন : রিসেলার (Reseller) হিসেবে অনলাইন থেকে আয় করা যায় কিভাবে?
কিভাবে ড্রপশিপিং বিজনেস শুরু করবেন ?
ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করার জন্য ধাপে ধাপে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন। এখানে ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করার প্রক্রিয়াটি বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
১. ড্রপশিপিং বিজনেস এর ধারণা বোঝা
ড্রপশিপিং হলো একটি ব্যবসার মডেল যেখানে আপনি কোনো পণ্য মজুত না করেই ড্রপশিপার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে অর্ডার সাপ্লায়ারের কাছে পাঠানো হয় এবং সাপ্লায়ার সরাসরি পণ্য গ্রাহকের কাছে পাঠিয়ে দেনা।
এই ব্যবসাটি আপনার জন্য পারফেক্ট কিনা সেটি বুঝতে হবে। এটি এমন একটি যেখানে আপনাকে মার্কেটিং এ যথেষ্ট দক্ষ হতে হবে।
এছাড়া সরবরাহকারীরা প্রায় সবাই কাছাকাছি ধরণের পণ্য সরবরাহ করে তাই এখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি । তাই আমি বলবো ভাল করে বুঝে তারপর এই ব্যবসায় আসুন ।
২. একটি লাভজনক নিশ নির্বাচন করুন
নিশ হচ্ছে মার্কেটের একটি সুনির্দিষ্ট ভাগ। আপনাকে প্রথমেই নিশ নির্বাচন করতে হবে। কারণ আপনি যদি মনে করেন আপনি সব ধরণের পণ্য নিয়ে ব্যবসা করে ফেলবেন তাহলে আপনি ভুল করছেন।
বিগিনার অবস্থায় আপনাকে অবশ্যই নিশ নিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি চেষ্টা করবেন লাভজনক নিশ সিলেক্ট করতে ।
এমন পণ্য নির্বাচন করুন যেগুলোর চাহিদা বেশি এবং প্রতিযোগিতা কম। এজন্য আপনি কীওয়ার্ড রিসার্চ করতে পারেন ।
কীওয়ার রিসার্চ করে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন মানুষ কোন বিষয়গুলো বেশি খুঁজে থাকে। এছাড়া গবেষণার ক্ষেত্রে আপনি গুগল ট্রেন্ড, ফেসবুক অডিয়েন্স ইনসাইট,, SEMrush ব্যবহার করতে পারেন ।
৩. ড্রপশিপিং বিজনেস এর জন্য সাপ্লায়ার খুঁজুন
ড্রপশিপিং ব্যবসায় সঠিক সাপ্লায়ার খুজে বের করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই ব্যবসায়ের সাফল্য অনেকটাই সাপ্লায়ারের উপর নির্ভর করে।
এর কারণ হচ্ছে আপনি যখন ক্রেতার কাছ থেকে অর্ডার পাবেন তখন সাপ্লায়ার যদি সেই পণ্য গুণগত মান বজায় রেখে যদি সঠিক সময়ে আপনার গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে না পারে তাহলে আপনি গ্রাহক হারাতে পারেন।
এজন্য প্রতিষ্ঠিত প্লাটফর্ম যেমন AliExpress, Oberlo, বা CJ Dropshipping-এর মতো বিশ্বস্ত সাপ্লায়ার বেছে নিন। সাপ্লায়ারের রিভিউ ও রেটিং যাচাই করুন।
৪. অনলাইন স্টোর তৈরি করুন
ড্রপশিপিং বিজনেস শুরু করার জন্য আপনাকে একটি ই-কমার্স স্টোর তৈরি করতে হবে। এই স্টোরে সাপ্লায়ারের পণ্য প্রদর্শন করবেন।
বিভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আপনি একটি অনলাইন স্টোর তৈরি করতে পারেন যেমন Shopify, WooCommerce, বা BigCommerce-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারেন।
প্রফেশনালি ওয়েবসাইট ডিজাইন করুন। সহজ নেভিগেশন, মোবাইল ফ্রেন্ডলি ডিজাইন এবং পেমেন্ট গেটওয়ে সেটআপ করুন।
সঠিকভাবে পণ্যের বিবরণ প্রদান করুন যাতে ক্রেতা বিবরণ পড়ে পণ্য সম্পর্কে ভাল একটা ধারণা পেতে পারেন।
উচ্চ মানের ছবি মানুষকে আকর্ষণ করে ভাল কোয়ালিটির আকর্ষণীয় ছবি ব্যবহার করুন। মূল্য নির্ধারণে বাজার বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করুন।
৫. মার্কেটিং পরিকল্পনা তৈরি করুন
আপনি দেখবেন ড্রুপশিপিং জগতে আপনার মত হাজারো ড্রপশিপার ব্যবসা করছে। তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে আপনাকে মার্কেটিং এ দক্ষ হতে হবে।
৬. লজিস্টিকস এবং গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করুন
ড্রপশিপিং এ লজিস্টিকস এবং গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করা একটা বড় ফ্যাক্টর। যেহেতু এই প্রক্রিয়াটা অনলাইন ভিত্তিক তাই গ্রাহকদের ডেলিভারি স্ট্যাটাস জানানোর ব্যবস্থা করুন।
রিটার্ন এবং রিফান্ড পলিসি ঠিক করুন। সহজ ও গ্রাহক-বান্ধব নীতি রাখুন। বেশিরভাগ গ্রাহক রিফান্ড পলিসিকে খুব গুরুত্ব দেন।
যেসব বিক্রেতা তাদের পণ্যের ক্ষেত্রে গ্রাহক বান্ধব রিফান্ড পলিসি তৈরি করেন তাদের তাদের গ্রাহকদের আস্থা থাকে বেশি যার কারণে বিক্রির পরিমাণ বেশি হয়।
গ্রাহকদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নিন। তারা আপনার পণ্য ব্যবহার করে কতটুকু সন্তুষ্ট তা জানতে চান। গ্রাহকরা যদি কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় সেটা সমাধান করার চেষ্টা করুন।
৭. ফলাফল বিশ্লেষণ করুন এবং উন্নতি করুন
কিভাবে ড্রপশিপিং বিজনেস এর আয়ের হিসাব করা হয়?
সরবরাহকারীর কাছ থেকে কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করে সেটা তুলনামূলক বেশি দামে বিক্রেতার নিকট বিক্রি করে একজন ড্রপশিপার মূলত আয় করে থাকে ।
অর্থাৎ আপনি পণ্যের জন্য যে দাম ক্রেতার কাছ থেকে নিচ্ছেন এবং সরবরাহকারীকে যে দাম দিচ্ছেন তার মধ্যে পার্থক্যই আপনার লাভ।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি একটি পণ্য ১০০ টাকায় বিক্রি করেন এবং সরবরাহকারীকে ৭০ টাকা দেন, তাহলে ৩০ টাকা আপনার লাভ। অর্থাৎ আপনাকে লাভ করতে হলে সরবরাহকারীর নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হবে।
ভালো বিপণন কৌশল ব্যবহার করে আপনি আপনার স্টোরে বেশি ভিজিটর আনতে পারেন, যা আপনার বিক্রয় বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে। এছাড়া চাহিদাসম্পন্ন এবং লাভজনক পণ্য বিক্রয়ের জন্য নির্বাচন করলে আয় বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।
ড্রপশিপার কত প্রকার?
মূলত চার প্রকারের ড্রপশিপার আছে:
১. বিগিনার এ ড্রপশিপার
২. বিগিনার বি ড্রপশিপার
৩. ইন্টারমেডিয়েট ড্রপশিপার
৪. এডভান্সড ড্রপশিপার
বিগিনার এ ড্রপশিপার : এই পর্যায়ের ড্রপশিপার ড্রপশিপিং ব্যবসায় একেবারে নতুন। যেহেতু ব্যবসায় তারা নতুন তাই তাদের অভিজ্ঞতার অভাব থাকে । এই পর্যায়ের ড্রপশিপাররা শিক্ষার পর্যায়ে থাকে। নতুন অবস্থায় তারা খুব বেশি যায় করতে পারে না। এই পর্যায়ের ড্রপশিপার মাসে ৫০০ ডলার পর্যন্ত আয় করে থাকেন।
বিগিনার বি ড্রপশিপার : এই ক্যাটাগরির ড্রপশিপাররা কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করার কারণে তাদের আয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। তারা এই ব্যবসার ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে । এই পর্যায়ে ড্রপশিপাররা ১০০০ ডলার পর্যন্ত আয় করে থাকেন।
ইন্টারমিডিয়েট ড্রপশিপার : এই পর্যায়ে ড্রপশিপার তাদের ব্যবসা সম্পর্কে মোটামুটি অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেন এবং ড্রপশিপিং ব্যবসার কৌশলগুলো সফলভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
কোন ধরনের পণ্য কাদের সামনে প্রমোট করতে হবে এবং কিভাবে গ্রাহককে কনভিন্সড করে বিক্রি বাড়াতে হবে সেটি শিখে যায়। এই পর্যায়ে ড্রপশিপাররা মাসে ৫০০০ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
এডভান্সড ড্রপশিপার : এডভান্সড ড্রপশিপার ড্রপশিপিং ব্যবসায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তারা ড্রপশিপিং ব্যবসার সকল কলাকৌশল ব্যবহার করে থাকেন এবং বড় মার্কেট প্লেয়ার হয়ে যান। এদেরকে ড্রপশিপিং মার্কেটের লিডার বলা হয়।
ড্রপশিপিং বিজনেস শুরু করার প্লাটফর্ম
ড্রপশিপিং বিজনেস শুরু করার জন্য অনেকগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা আপনাকে সহজে একটি অনলাইন স্টোর তৈরি করতে এবং আপনার ড্রপশিপিং পরিচালনা করতে সহায়তা করবে। নিচে কয়েকটি জনপ্রিয় ড্রপশিপিং ওয়েবসাইট এর তালিকা দেওয়া হলো:
১. Shopify
Shopify ড্রপশিপিং-এর জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি। শপিফাই এর গ্রাহকরা সহজেই তাদের অনলাইন স্টোর তৈরি, কাস্টমাইজ এবং ব্যবস্থাপনা করতে পারে ।
এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা প্রোডাক্ট লিস্টিং, ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনা, পেমেন্ট প্রসেসিংসহ আরো অনেক সেবা পেয়ে থাকে ।
প্রাথমিকভাবে শপিফাই ৩ দিনের জন্য ফ্রি ট্রায়াল ব্যবহার করা যায়। ৩ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের যেকোন একটা প্ল্যান ক্রয় করতে হয়।
২. WooCommerce (WordPress)
WooCommerce হলো একটি ফ্রি ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগিন যা ব্যবহার করে ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইটে অনলাইন স্টোর তৈরি করা যায়। এই প্লাগিনে আপনি ইকমার্স এর পরিপূর্ন ফিচার পাবেন। এর মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই আপনি প্রোডাক্ট লিস্টিং থেকে শুরু করে প্রোডাক্ট সেলিং ম্যানেজমেন্টসহ সবকিছু করতে পারবেন । স্টেপ বই স্টেপ বিস্তারিত জানতে পড়ুন : WooCommerce এর মাধ্যমে অনলাইনে ব্যবসা করার গাইডলাইন।
৩. BigCommerce
BigCommerce এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে আপনি সহজেই আপনার ড্রপশিপিং ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন। এই প্লাটফর্মের বিশেষ কিছু ফিচার হচ্ছে :
- অনলাইন স্টোর কাস্টমাইজ করার প্রচুর অপশন আছে,
- কেন্দ্রীয় পণ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি,
- সহজেই ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনা ,
- তাদের সরবরাহ করা মার্কেটিং এবং এসইও টুল অনলাইন স্টোরে ট্রাফিক বাড়াতে সাহায্য করে,
৪. Wix
Wix eCommerce একটি সহজ প্ল্যাটফর্ম যেখানে আপনি সহজেই কাস্টমাইজেশন এবং ডিজাইনিং এর সুবিধা পাবেন। এটি নতুনদের জন্য বেশ উপযুক্ত।
আপনি মাসিক ২৭ ডলার থেকে ১৫৯ ডলারের মধ্যে ওদের বিভিন্ন ধরণের ফিচার ব্যবহার করতে পারবেন যা দ্বারা আপনি সহজেই আপনার ড্রপশিপিং ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন ।
৫. AliDropship
AliDropship একটি ব্যবহার বান্ধব ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগইন যার মাধ্যমে একজন ড্রপশিপিং ব্যবসায়ী তাদের ড্রপশিপিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের বিভিন্ন ফিচার ব্যবহার করে সহজেই ড্রপশিপিং ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে । এটি AliExpress এর সাথে সংযুক্ত।
এই প্লাটফর্মের একটি বড় ফিচার হচ্ছে আপনি AliExpress এর মাধ্যমে সরাসরি পণ্য আমদানি করে আপনার অনলাইন স্টোরে যুক্ত করতে পারবেন। ক্রোম ব্রাউজারে AliDropship এক্সটেনশন ব্যবহার করে আপনি এই কাজটি করতে পারবেন ।
৬. Magento
Magento (Adobe Commerce) একটি PHP দ্বারা তৈরি প্লাটফর্ম যেখানে প্রোগ্রামাররা তাদের অনলাইন স্টোর তৈরি করতে পারেন। পৃথিবীর হাজারো ব্যবসায়ী এই ওপেন সোর্স প্লাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের অনলাইন স্টোর খুলে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
ছোট থেকে মাঝারি ধরণের ব্যবসার যাদের অনেক বেশি কাস্টমাইজ এর প্রয়োজন হয় তাদের জন্য এটি একটি উপযুক্ত প্লাটফর্ম । আবার বড় ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তাদের অনলাইন ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে Magneto থেকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট পরিমানে সাপোর্ট পায়।